নেশা, পর্নোগ্রাফি, মোবাইল, পরকীয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো বর্তমানে বিশ্বব্যাপী একটা বড় সমস্যা। নেশা মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নেয়। শুধু মাদকই নয়, আসক্তি অনেক রকমের হতে পারে। আসক্তির ব্যাপারে পরিবারের লোকজনকে সচেতন হতে হবে। নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতা কমাতে হবে।
বিয়ে জীবনের একটা গুরত্বপূর্ণ অধ্যায়। মা–বাবা, ভাই-বোনের সঙ্গে মানুষ ১৮-২০ বছর অবিচ্ছেদ্য আবহে কাটায়। জীবনের বাকি অংশ কাটায় স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে একই ছাদের নিচে। কাজেই বন্ধন বেশি দেখা যাচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর অংশে। কিন্তু বর্তমান সমাজে কোনো কোনো পরিবারে ভাঙনের সুর বিয়ের বছরখানেকের মধ্যেই বাজতে শুরু করে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এ প্রবণতা আগে এতটা ছিল না।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এক দশক আগে ৭০ শতাংশ বিচ্ছেদ হতো ছেলের দিক থেকে। আর সাম্প্রতিক কালে ৮০ শতাংশ বিবাহবিচ্ছেদ হয় মেয়েপক্ষ থেকে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে গত ৬ বছরে ৫০ হাজার বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় একটি বিচ্ছেদ মামলা হয়।
খুলনা সিটি করপোরেশনের পরিসংখ্যান বলছে, গত সাড়ে ১০ বছরে প্রতি ১০টি বিচ্ছেদ আবেদনের মধ্যে ৭টিই হয়েছে মেয়েপক্ষ থেকে।
বিচ্ছেদের কারণ
মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন, বিত্তবৈষম্য, কুসংস্কার, অজ্ঞানতা ও অশিক্ষার কারণে বিবাহবিচ্ছেদ হয়। দম্পতির কেউ একজন পেশাগত কারণে দূরে অথবা প্রবাসে থাকলে নিজেদের অজান্তেই দূরত্ব বাড়ে। এ ছাড়া যৌন বিকৃতি, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে এর জন্য দায়ী মনে করা হয়।
নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অর্থনৈতিক উন্নতি অনেক ক্ষেত্রে স্বামী বা তার পরিবারের চক্ষুশূল। অনেক বিবাহবিচ্ছেদে এই মানসিক সংকট ও টানাপোড়েন প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করছে।
তবে মানসিক রোগের কারণে কত যে ডিভোর্স হচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই। এর মধ্যে ওসিডি, বাইপোলার, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার, মাদকাসক্তি অন্যতম। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমাজে প্রবল অসচেতনতা কাজ করে।
মাদকাসক্তে যেখানে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করা প্রয়োজন, অদ্ভুত এক বিশ্বাসে উল্টো এসব রোগীকে বিয়ে করিয়ে দেওয়া হয়।
এ অবস্থায় করণীয়
- বিবাহবিচ্ছেদের আগে কেন তারা বিয়ে ভাঙতে চাইছেন, সে কারণ খুঁজতে হবে। আগে পরিবারের সদস্যরা মিলে আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে সুরাহার চেষ্টা করতেন। জ্যেষ্ঠ স্বজনেরা এ ক্ষেত্রে দুর্দান্ত ভূমিকা দেখাতেন। এটা কিন্তু সব সময়ই বিচ্ছেদ ঠেকানোর ভালো কৌশল। এ চর্চা সব পরিবারে থাকা দরকার।
- একটি পরিবারের বৃহৎ পরিসরে বন্ধন অটুট না থাকলে উপকার পাওয়া যায় না। এখন নগরে, মহানগরে মূল পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছোট পরিবার বাড়ছে। এ ধরনের সংসারে বিচ্ছেদ আসন্ন হলে পরিবারের অন্যদের পরামর্শ নিতে পারেন। পেশাদার মনোরোগ চিকিৎসক ও কাউন্সেলরদের কাছেও যেতে পারেন।
- একে অপরকে সন্দেহ করার আগে তার কারণ খুঁজে বের করুন। অকারণ সন্দেহ নয়।
- দুজনই পরিবারে সময় দিন। ভালোবাসা বাড়ান দুজনের মধ্যে।
- সুস্থ, সুন্দর, উন্নত সমাজ গঠনে পুরুষের উচ্চশিক্ষা, আয়–উন্নতি যেমন কাঙ্ক্ষিত; তেমনি নারীর উচ্চশিক্ষা ও আয়-উন্নতি কাঙ্ক্ষিত। পরিবারে পুরুষের ক্ষমতায়ন যেমন ইতিবাচক, তেমনি নারীর ক্ষমতায়নও ইতিবাচক। নারীর উন্নতি বিবাহবিচ্ছেদের কারণ নয়। পশ্চাৎপদ দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ফেলুন। নারীর উন্নতি একটি পরিবারের ভিত্তিকে মজবুত করে।
- দাম্পত্যে কোনো সমস্যাকে বড় করে দেখার আগে আত্মবিশ্লেষণ ও উপলব্ধি বাড়ানোর চেষ্টা করুন। আপনার কী কী ভুল আছে, সেটাও বুঝুন। দুই পক্ষের ভুলগুলো নিয়ে নিজেরাই বসুন। আলোচনা করুন। নিজের ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার অঙ্গীকার করুন এবং চেষ্টা করুন। তারপর অন্য পক্ষের ভুল শোধরানোর তাগাদা দিন।
- দম্পতির কাছের স্বজনেরাও দুই পক্ষের ভুলগুলো আমলে নিন। আপনার সন্তানের ভুলত্রুটিগুলো শোধরাতে বলুন। একের ভুল অন্যের ওপর চাপিয়ে বা কোনো ভুল ধামাচাপা দেবেন না। দুই পরিবার একত্রে বসার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সমস্যা দেখা দেয়। এতে সংসার জোড়া লাগার বদলে ভেঙে যায়।
- অনেক সময় বিবাহবিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে ওঠে অবুঝ ভুলের জন্য। সেসব আমলে নিন। সামলে চলার চেষ্টা করুন।
- সারা বিশ্বের মনোবিদেরাই সুস্থ সংসারের পক্ষে। বিবাহবন্ধন অপূর্ব এক সুরক্ষা, আত্মরক্ষা; জীবনগতির সচল সক্ষম চাকা। এই সংসার নির্বন্ধ এখনো বিশ্বজুড়ে জীবনযাপনের সেরা ও অব্যর্থ টনিক। বিবাহবন্ধনের মধ্যেই আছে যৌথ মুক্তির আশ্বাস। এ বিশ্বাসকে মজবুত করুন।
- ইউরোপীয় এক মনোরোগ চিকিৎসকের মোক্ষম কথা হলো, ‘ভাঙার জন্যই তো সংসার ভাঙছ না। ভাঙছ নতুন কিছু গড়ার জন্য। আবার শুরুর জন্য। যদি তা–ই হয়, তবে যে ভিত্তি এত দিন ধরে তিলে তিলে গড়ে তুললে, সেটা আরও মজবুত করে নিচ্ছ না কেন!’
ডা. সুলতানা আলগিন : সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ এবং ওসিডি ক্লিনিক কনসালট্যান্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
আমার ক্যাম্পাস/ঢাকা/আর এম
Leave a Reply